ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেলাম?

ট্রেন চলছে দুরন্ত গতিতে।ট্রেনের এক কামড়ায় স্বামী-স্ত্রী বসে যাচ্ছে অজানা পথে।বিষন্ন মনে বাহিরের প্রকৃতি দেখে, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারাতে চেষ্টা করছে।হঠাৎ স্বামীর দিকে ফিরতেই দেখে, উনার স্বামী এক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনি লজ্জায় পড়ে যান।লজ্জা-মাখা মুখে মৃদু হাসি চলে আসে।মনের দুঃখ ভুলে লজ্জা-মাখা মুখে উনার স্বামীকে বলেন
.
- এমন করে কি দেখছেন? আমার লজ্জা করে না বুঝি!
- তোমাকে দেখছি।যতবার দেখি ততবারেই মনে হয় তোমাকে প্রথম দেখছি।স্বামী দেখলে যদি লজ্জা করে! তাহলে কে দেখলে লজ্জা কমবে?
অভিমানী সুরে বলেন
- আপনি সব সময় বেশি বলেন।এবং সব সময় বেশি বুঝেন।একটু কম বলতে পারেন না? একটু কম বুঝতে পারেন না?
- আমি বেশি বুঝি! না তুমি বেশি বুঝ? মজা করে যে বলছি কেন তুমি বুঝ না?
.
হঠাৎ ঐ ঘটনাটা মনে পড়ে যায়।বিষন্ন মনে স্বামীকে বলেন
- সব সময় বুঝতে ভালো লাগে না।
আলতু করে বউ এর হাতে হাত রেখে বলেন
- আমার বউ এর কণ্ঠে এতো অভিমান কোথা থেকে আসে?
হাতটা ছেড়ে বলেন
- ছাড়েন এখন আদর দেখাতে হবে না।আমার কোন কথার তো দাম নাই।
- সত্যিই তো? কোন কথার দাম দেই না?
- হ্যাঁ সত্যি।
অভিমানী সুরে বলেন
- ঠিক আছে।আমার আর কিছু বলার থাকল না।

ট্রেন চলছে, তাদের রাগ-অভিমান এর পাল্লা একবার কমছে একবার বাড়ছে।স্বামীর নাম তাওহীদ রহমান।স্ত্রীর নাম ফারাহ রহমান।একটু পর পর একজন আর একজনকে আড় চোখে দেখছেন।আর মনে মনে নিজেরাই কষ্ট পাচ্ছেন।কিন্তু মুখে তা কেউ প্রকাশ করছে না।তাদের মুখের প্রকাশ ভঙ্গি দেখলে যে কেউ মনে করবে তারা কেউ কাউকে চিনে না।
.
তাওহীদ রহমান ও ফারাহ রহমান এর বিয়ের বয়স এক বছর।উনারা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছেন।হঠাৎ ফারাহ রহমানের আইসক্রীম খাওয়ার সখ জাগে।তাওহীদ রহমান উনাকে আইসক্রীম খাওয়ান।কিন্তু উনার স্ত্রী আইসক্রীম খেয়েই যাচ্ছিলেন।ফারাহ রহমান এর অতিরিক্ত আইসক্রীম খেলে টনসিলের সমস্যা হয়।তাই উনি না করেন।আর তাতেই তিনি রাগ করে বসেন।তাওহীদ রহমান অনেক বার সরি বলেন।কিন্তু উনি ক্ষমা করেননি।তারপর উনি ট্রেনের কামড়ায় ঐ পথটা বেছে নেন।

ট্রেন চলছে, তাদের মনের মাঝে পুরোনো স্মৃতিগুলো বার বার এসে ভিরছে।মনের গহীনে দুজনেই একটা ব্যথা অনুভব করে।মনের অজান্তেই তাদের হৃদয়টা কেঁদে ওঠে।দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যায়।তবুও তাদের মাঝে রাগ-অভিমান রয়ে যায়।পড়ন্ত বিকেলের ডুবন্ত সূর্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে তলিয়ে যেতে থাকে। নীড় হারা পাখিরা নীড়ে ছুটতে থাকে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারাহ রহমান বলেন
.
- এই যে! এই যে! শুনছেন?
.
কিন্তু তাওহীদ রহমান কথা বলেন না।একটু লক্ষ করতেই দেখেন উনার চোখের কোণে পানি জমে আছে।হু হু ফারাহ রহমান এর হৃদয়টা কেঁদে ওঠে।এখন নিজেই নিজেকে একটার পর একটা গালি দিয়ে যাচ্ছেন।কান্না ভেজা কণ্ঠে আবার বলেন
.
- আমাকে ক্ষমা করে দেন আমি আর কখনও ভুল বুঝব না।
- আমি কে? আমি তো আপনার কেউ না।
রাগ উঠলে আপনি আপনি করে বলেন।চোখের পানি মুছে বলেন
- এসব কথা মুখেও নিবেন না।আপনিই আমার সব।আপনাকে ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার।
- না, আমি তো কেউ না।যদি কেউ হইতাম।তাহলে মানুষের ভাল যে চেয়েছিলাম সেটা বুঝত।আমি মরে---
.
কথাটা শেষ করতে পারেননি; তার আগেই মুখ চেপে ধরে।দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
- সাবধান আর একবার এই কথা বললে প্রথমে আপনাকে মারব তারপর নিজে মরব।
- তাওহীদ রহমান কি বলবেন? কিছু বলতে পারেননি।শুধু ফারাহ রহমান এর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
.
পড়ন্ত বিকেলের ডুবন্ত সূর্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে লাল আভা ধারণ করছে।রাগ-অভিমান ভুলে দুজনে এক সাথে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবা দেখতে থাকেন।

হঠাৎ ট্রেনের হইসেলে তাওহীদ কল্পনা থেকে ফিরে আসে।কিন্তু মনের ভুলে বউ বলে ডাকতে থাকে।
- বউ! বউ! কোথায় গেলে? আমরা এসে পড়েছি; ট্রেন থেকে নামবে না?
- তাওহীদ! এই তাওহীদ! এসব কি বলছিস?
কিন্তু তারপরেও বউ বউ বলে ডাকতেই থাকে।
- ঐ শালা তুই কোন জীবনে বিয়ে করছিলি? তোর বউ কোথা থেকে আসব?
বন্ধুর গালি খেয়ে বাস্তব জগতে ফিরে আসে।
- কিছু না বলে ঐ মেয়েটাকে খুঁজে, কিন্তু কোথাও তার ছায়াটুকু দেখতে পায় না।তার মনের আকাশে মেঘ জমে যায়।বুকের মাঝে কষ্ট অনুভব করে।
.
তাওহীদ ট্রেনে উঠার পর তার বন্ধুর সাথে কথা বলছিল।হঠাৎ অন্য একটা সীটে চোখ পড়তেই তার সব কিছু থমকে দাঁড়ায়।এক পলকে তাকিয়েই থাকে।তার বন্ধুর কোন কথায় তার কানে যাচ্ছে না।তাওহীদ মনে মনে বলে, কোনো মেয়ে এতো সুন্দর হতে পারে? সে শুধু মেয়েটার মুখ দেখতে পেরেছিল।কারণ ও হিজার পড়া ছিল।ওর দিকে তাকাতেই তার মনে হয়েছে।তার চোখে চোখ রেখে তার সাথে কথা বলছে।তাওহীদ চোখ দুটো বন্ধ করতেই; মনের অজান্তে তাকে নিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যায়।
.
ঘন কালো দুটো চোখ।একটু পর পর মুচকি মুচকি হাসি তাওহীদকে পাগল করে দিচ্ছে।তার বুকের মাঝে ঝড় তুলে ছাড়ছে।মেয়েটা একবার না দুইবার শুধু তার দিকে তাকিয়ে ছিল।আর তাতেই মেয়েটার চোখের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।সে তার চোখের প্রেমে পড়ে।তাওহীদ ভাবতে পারেনি তার জীবনে এমন একটা দিন আসবে।একবার কার সাথে যেন ফোনে হেসে হেসে কথা বলছিল।তাওহীদের বুকের ভিতরটায় মুচড় দিয়ে উঠেছিল।তখন তার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
.
তাওহীদকে ডাকছে কিন্তু সে কথা বলছে না।তার হাবভাব দেখে তার বন্ধু বোকা বনে চলে যায়।সেও ঐ দিকে তাকায়; আর তাকাতেই তার দুনিয়াটাও ঘুরে যায়।তার বুকের মাঝে ভালোবাসা জেগে ওঠে।ঐ মেয়েটার জন্য কল্পনায় রাজ মহল তৈরি করে ফেলে।আরও কতকিছু চিন্তা করে তার কোন হিসাবেই নেই।এভাবেই দুই বন্ধু প্রেমের সাগরে হারিয়ে গিয়েছিল।আবার ট্রেনের হইসেলে তাদের প্রেমের সাগর থেকে ফিরে আসে।

তাওহীদের চোখে এখনও মেয়েটার মিষ্টি হাসি ভেসে বেড়াচ্ছে।বুকের মাঝে একটা চিন চিন ব্যথা অনুভব করছে।তাওহীদ তার বন্ধুকে আহত সুরে বলে
.
- বন্ধু! আমার কোনদিন বিয়ে হবে নারে।
- ঐ শালা একদম চুপ।কখন থেকে এসব উল্টা-পাল্টা কথা কেন বলছিস?
.
- বন্ধু! গালি সমস্যা না।কিন্তু বন্ধু! আমি ঐ মেয়েটাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারব নারে।
.
- ওলে বাবা লে বাবা ছেলে কত বড় হয়েছে।ছেলের বিয়ের বয়স মনে হয় চলে যাচ্ছে!
.
- বন্ধু! এভাবে বলিস না।বন্ধু! আমার বিয়ে হলেও অন্য মেয়েরা সব পাবে কিন্তু আমার মন কেউ পাবে না।আমি আমার মন তাকে দিয়ে ফেলেছি।
.
- আহারে বন্ধুটার কি দুঃখ! যে মেয়ে আসবে সে মেয়ে তো নিশ্চিত মরবে।কারণ আমার বন্ধুর দেহ পাবে কিন্তু মন পাবে না।আমার বন্ধু প্রেমিক পুরুষ যাকে মন দিয়েছে একবারেই দিয়েছে।
- বন্ধু তুই আমার সাথে মজা করছিস?
.
- তুই বল কি শুরু করছিস।কোথাকার কোন মেয়েকে দেখে বোকার মতো আবল-তাবল বকছিস।তোর মতো ছেলে এসব করে?
.
- বন্ধু! এ আমি কেমন প্রেম করলাম? প্রেম করার আগেই ছ্যাকা খাইলাম!
- চিন্তা করিস না, আল্লাহ তায়ালা তোর কপালে যাকে রাখছে সেই আসবে।

তাওহীদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।আবার ঐ সীটটার মাঝে তাকায়।মনের মাঝে এখনও মেয়েটার হাসি ভেসে উঠছে।মেয়েটাকে এক নজর দেখার জন্য অনেক খুঁজাখুঁজি করে।কিন্তু তাকে কোথাও আর পায়নি।দুই বন্ধু ট্রেন থেকে নেমে হাটছে।তাওহীদ একটু পর পর পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে।
.
হঠাৎ দেখে, মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।মেয়েটাকে দেখে খুশিতে মনটা ভরে যায়।একবার চোখের পলক ফেলে তাকিয়ে দেখে সে নেই।মনে মনে বলে, এ আমি কেমন ছ্যাকা খাইলাম! শুধু শুধু
ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেলাম? মনের অজান্তেই হেসে ফেলে, তারপর আবার হাটতে থাকে।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.